এখন আমার খুব কান্না পাচ্ছে
এখন আমার খুব কান্না পাচ্ছে। অথচ কান্না ঠিক কেমন হয় আমি মনে করতে পারছি না, ঠিক কীই বা মনে করতে চাইছি, কান্নার স্বাদ, কেমন দেখতে হয়, অথবা এমন কোনো বিশেষ গন্ধ যা দিয়ে পৃথক হওয়া যায়। মাঝে মাঝে তো এমনই মনে হয়, কেবল পৃথক হবার জন্যই আমরা গন্ধ ব্যবহার করি। নিশ্চয় তোমার মনে আছে ময়দানে একটা বিকেল অন্তত আমরা একসাথে কাটিয়েছিলাম - খুবই সাহিত্যপন্থী হয়ে পড়ছি আমরা আজকাল, নয়ত হঠাৎ সকাল আর বিকেলের আলোকে আমাদের এক মনে হবে কেন, আর সেই আলো পৃথক করতে কেনই বা খোঁজা হবে ক্লান্তির পার্থক্যরেখা। তোমার কি মনে আছে, পৃথকত্ব আমায় খুবই আনন্দ দিয়েছিলো? পৃথকত্ব, পৃথকত্বই কি, অথবা পৃথকত্বের আবিষ্কার। যেকোনো বিকেলই এভাবে আমায় তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারে না। অথচ, আজ পৌঁছেছি। এমনই সে যাতায়াত, তুমি বিমূঢ় জিগেস করছ কেন এসেছি। এখুনি যদি বলি, তোমার ঘরের জানলাটা দিয়ে আজ অদ্ভুত বিকেল দেখা যাচ্ছিলো। তোমার কাছে অনেক ভিড় ছিলো। আমি তাই বিকেল দেখতে গেছিলাম। মনে পড়ল ময়দানে একটি মেয়ের কাছে খুব সুগন্ধ পেয়েছিলে, আমি কি খুব রেগে গেছিলাম অথবা নীরব মন্তব্য করেছিলাম ফাঁকা ময়দানে এরা গন্ধ মেখে ঘোরে কেন, গন্ধ ভিড়ের, একার নয়। পৃথক হতে হতেও পৃথক হবার টাল সামলাতে না পেরে মেয়েটি কি আলতো ঢলে পড়েছিল তোমার গায়ে? আর তুমি তাকিয়ে ছিলে খুব মোলায়েম?
অথচ, কথা হলো আমার এখন কান্না পাচ্ছে প্রবল। চোখ জ্বালা করছে। আমাদের বাড়িতে যখন প্রথম গ্যাস সিলিন্ডার এল, তার পর থেকে পাশের বাড়িতে উনুনে আগুন উঠলে, যেমন চোখ জ্বলত, তার সাথে এসব জ্বলার কোনো মিল আছে কি না আমার মনে পড়ছে না। কান্না কেমন তাও আমার মনে পড়ছে না। আহ। আমি বোধহয় আমার অসুখটা টের পাচ্ছি, ক্রমাগত আমি ভুলে যাচ্ছি। আমি, ভুলে যাচ্ছি। তোমাকে ভুলে যাবার ভয়ে দেখে আসছি বারবার, অথবা কেবলই আমি বিকেল দেখতে গেছি। এভাবে আমি আরো কী কী ভুলে যেতে পারি। আমার খুব মনে হচ্ছে খুব শিগগির আমি অন্ধ হয়ে যাব, অতএব ভুলে যাব যে কখনোই আমি অন্ধ ছিলাম না। খুব শিগগিরই আমি চূড়ান্ত মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়াবো রাস্তা ঘাটে, এবং ভুলে যাব বরাবরই আমি এমনি মাতাল ছিলাম। একমাত্র যা বেঁচে থাকতে পারে, তা গন্ধ। শ্বাস বন্ধ হলে আমি মরে যাব কি না, এবিষয়ে আমি নিশ্চিত নই, একথা বললে আমার চারধারে একটা জনসমাগম হবে, হ্যাঁ, লোকটা বলেছে বটে আলাদা কিছু। পৃথক। তারপর আমার মৃত্যুর মুখোমুখি কতগুলো ফুলের তোড়া, আর ধূপের ধোঁয়া ছাড়া কিছুই ছুঁড়ে দেবে না ওরা। ওহ্, প্রবল গন্ধে আমার শ্বাসক্রিয়া দ্রুত হতে হতে হঠাৎ থেমে যাবে। এরকম সংবর্ধনাসভায় বলা হবে, আমি, কেবল আমিই পৃথক করেছি সকাল আর বিকেলের আলো। তোমার কথা কি কেউ বলবে না? আমার প্রসঙ্গেও কি তোমার কথা বলবার মত নেই কিছু? তুমি কী বলবে, কী বলতে পারো। দ্রুতগতিতে ভুলে যাবে যেসব কথা তোমার বহু আগেই ভোলা উচিত ছিলো। তুমি কিছুই বলবে না, যেমন বলোনি আজও, অথচ আমি যে শুনতে চেয়েছিলাম, সেটাই বলবে সবাইকে। যারা শুনবে, তারা কি দু-একবার কেঁদে ফেলবে না? বিশেষ, তোমার বলার ভঙ্গি এত অশ্রুপ্রবণ... পৃথক এমন, আমি উপযোগী বর্ণনা পাইনি কোনো। এমন পৃথক… আমি কি তবে কাঁদবার জন্য গিয়েছিলাম, বিকেল বিকেল বলে প্রবোধ খুঁজেছি, আর কিছু নয়।
আসল কথা হলো, আমার খুবই কান্না পাচ্ছে অথবা কিছুই মনে পড়ছে না। কারণ, কিছুই আমি ভুলতে পারছি না। এত স্পষ্ট, প্রত্যাখানের মত হয়ে রয়েছে কান্না যে কিছুতেই আমি ভুলতে পারছি না। মনে করতে পারছি না। কিছুই মনে না পড়লে ঠিক কী করতে হয়, স্মৃতির কাছে যেতে হয়, আমার কাছে। পৃথকত্বের কোনো কাছে যাওয়া নেই। কাছে যাবারও পৃথকত্ব নেই কোনো। এই সবই একই উপায়। কান্না, একইরকম।
আমি খুব অবান্তর কারণে তোমার কাছে যাব। আমি ক্রমাগত ভুলে যাচ্ছি দূরত্ব আর সম্পর্কের ধারণা।
আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না কান্না কেমন।
গুচ্ছ - কবিতা
১
বহুদিন পরে চায়ের গেলাস পাশাপাশি নামিয়ে রাখা হল
রাখা হল বুকের ভিতর জিভ পুড়ে যাবার মত স্বাদ
রাস্তার যেকোনো চায়ের দোকানই, ঐশ্বরিক ঐন্দ্রজালবিস্তার
বলো বিচ্ছেদ, কতদূরে তুমি, আর কতদূরে সমাধি তোমার?
২
তোমার অপেক্ষায় আছি বহুক্ষণ
কেউ জানে না, ওদের মিথ্যে বলেছি
যেকোনো তোমাকেই দেখলে ভাবছি পরিচিত পথ
পরিচিত জন দেখলে খুঁজছি আড়াল
ওরা কীকরে জানত, প্রতীক্ষাই সত্য মাত্র
এর বেশি আর কিছু নয়, কিছুই-
ওদের মিথ্যে বলেছি তাই।
৩
বৃষ্টির ফোঁটায় চিরে
দুভাগ হচ্ছে জল
দুভাগ হচ্ছে জল
একপারে সুস্পষ্ট আমি,
অন্যপারে অগম্য অতল
পদ্ম শালুক, এসব -
জলে ফোটেনি কখনোই
ক্ষতস্থান ঢেকেছে কেবল।
৪
কখন চোখ এড়িয়ে চলে গেছে সে,
চোখের দোষ ছিল, যোগাযোগেও -
কিছু বলতে চাওয়া বাতুলতা হবে ভেবে,
প্রায়ান্ধকার টেলিফোনে অপেক্ষা করেছে
অথচ চোখের ভুল, দুষ্প্রাপ্য পুথিঁর মতন।
৫
তুমি চলে গেলে নিশ্চিন্ত পথে
এখানে বরষা স্বয়ং অভিসারিকা
সমস্ত ভিজে গেলে, ছাতার কী হবে?
কী হবে ছন্দ, বরষার?
ওদেরও তো বর্ষা আছে,
যতটা আছে বর্ষা তোমার।
৬
প্রচন্ড বৃষ্টিতে ট্রেন দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ।
স্টেশনের নাম নেই। মাঝপথে নাম থাকে না কোনো - যেমন মানুষের। পিতা তুমি, সন্তান জন্মের ঐ পারে। প্রেমিক তুমি প্রেমের ঐ পারে। মাঝপথে নাম নেই। দুপাশে বৈদ্যুতিন খুঁটি রেখেছে বংশানুক্রমিক পরিচয়। সম্পর্কই পরিচয় কেবল। ঠাকুমার মৃত্যুর পর যে কাকটি হবিষান্ন খেয়ে যেত রোজ, সেও পরম আত্মীয় আমার। আত্মীয়, যেকোনো বিদ্যুৎপৃষ্ট কাক।
তৃষা চক্রবর্তী
Trisha Chakraborty